বর্তমান সময়ে ভুট্টা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান শস্য বা ফসল।যা মানুষের খাদ্য, পশুখাদ্য এবং শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভুট্টার বিভিন্ন জাতের হয়ে থাকে তার মধ্যে হাইব্রিড ভুট্টা বর্তমানে কৃষকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর কারণ হচ্ছে উচ্চ ফলন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং বিভিন্ন আবহাওয়ায় চাষের উপযোগিতা রয়েছে। এখানে আমরা হাইব্রিড ভুট্টার চাষ পদ্ধতি এবং সঠিক জাত নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করব।
হাইব্রিড ভুট্টার সুবিধা
হাইব্রিড ভুট্টা চাষের ক্ষেত্রে সাধারণত উচ্চ ফলন, দ্রুত বৃদ্ধি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা লক্ষ্য করা যায়। এটি সাধারণত স্থানীয় জাতগুলোর তুলনায় অধিক ফলনশীল। তাছাড়া, হাইব্রিড ভুট্টা বিভিন্ন ধরনের মাটি এবং আবহাওয়ায় ভালোভাবে অভিযোজিত হয়, যা কৃষকদের জন্য সুবিধাজনক।পক্ষান্তরে দেশীয় ভুট্টা কম ফলনশীল এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় অপ্রত্যাশিত।
ভুট্টা চাষের প্রস্তুতি
আমাদের দেশের অধিকাংশ কৃষকেরা একটা চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে জানে না ।সঠিকভাবে ভুট্টা চাষের পদ্ধতি না জানার কারণে ভুট্টার ফলন অনেক অংশ কমে যায়। আমরা এখন ভুট্টা চাষের সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে আপনাদের সামনে তুলে ধরব।
মাটি নির্বাচন ও প্রস্তুতি
ভুট্টা চাষের জন্য বেলে দোঁআশ বা দোঁআশ মাটি উপযুক্ত। মাটির সুষ্ঠু ড্রেনেজ ব্যবস্থা থাকা জরুরি, কারণ ভুট্টা স্থায়ী জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। মাটির পিএইচ ৫.৫ থেকে ৭.৫ এর মধ্যে থাকা উচিত। জমি চাষের আগে, মাটিতে ২-৩ বার গভীর চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করতে হবে এবং আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
বীজ বপন ও জমি প্রস্তুতি
ভুট্টা চাষের জন্য বীজের মান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক জাত নির্বাচন এবং গুণগত মানের বীজ ব্যবহার করলে ফলন বৃদ্ধি পায়। হাইব্রিড বীজ ব্যবহার করলে ভাল ফলাফল পাওয়া যায়। প্রতি হেক্টর জমির জন্য ১৮-২৫ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়। বীজ বপনের আগে, মাটিতে প্রয়োজনীয় জৈব সার ও রাসায়নিক সার মিশিয়ে দিতে হবে।
হাইব্রিড ভুট্টার সঠিক জাত নির্বাচন
হাইব্রিড ভুট্টার অনেক ধরনের জাত আছে, যা আবহাওয়া এবং মাটির ধরন অনুযায়ী নির্বাচন করতে হয়। নিচে কিছু জনপ্রিয় হাইব্রিড ভুট্টার জাতের তালিকা দেওয়া হল:
বি আর ৯: এ জাতটি উচ্চ ফলনশীল এবং ১২০-১৩০ দিনের মধ্যে পরিপক্ক হয়। এর দানা বড় এবং গঠন সুন্দর।
পি এইচ বি ৭১: মধ্যম সময়ে পরিপক্ক হওয়া এ জাতটি চাষ করা সহজ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি।
সুপার চ্যাম্প: এটি গরম অঞ্চলে ভালো ফলন দেয় এবং উচ্চ তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে।
এফ বি ৭৪০: জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে অভিযোজিত এ জাতটি মাঝারি সময়ে পরিপক্ক হয় এবং অধিক ফলন দেয়।
বীজ শোধন
বীজ বপনের আগে বীজ শোধন করা জরুরি। বীজ ভবনের পূর্বে তা ভালো করে রোদে শুকাতে হবে এবং নিম্নমানের অথবা নষ্ট বীজ ফেলে দিতে হবে।এ জন্য বাজারে পাওয়া যায় এমন বীজ শোধনকারী পদার্থ ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি ফসলকে বিভিন্ন ধরনের ছত্রাক ও রোগ থেকে রক্ষা করে।
ভুট্টার সার ব্যবস্থাপনা
ভুট্টা চাষের ক্ষেত্রে সঠিক সার ব্যবস্থাপনা ফলন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাধারণত, প্রতি হেক্টরে ২৫০-৩০০ কেজি ইউরিয়া, ২০০ কেজি টিএসপি, এবং ১০০ কেজি এমওপি প্রয়োগ করতে হবে। এর মধ্যে অর্ধেক ইউরিয়া এবং অন্যান্য সার চাষের আগে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। বাকি ইউরিয়া গাছ বড় হওয়ার সময় দুই ধাপে প্রয়োগ করতে হবে।
সেচ ব্যবস্থাপনা
ভুট্টা গাছ সঠিক সময়ে সেচের প্রয়োজন হয়। গাছের বপনের ২০-২৫ দিন পর প্রথম সেচ এবং দ্বিতীয় সেচ ৪০-৪৫ দিন পর দিতে হবে।জমির পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকা উচিত।মনে রাখবেন এমন ভাবে সেচ দেওয়া যাবে না যেখানে পানি জমা হয়ে থাকে।
রোগ ও পোকা দমন
হাইব্রিড ভুট্টার বিভিন্ন রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হতে পারে। এর মধ্যে লিফ ব্লাইট, স্টেম বোরার, এবং ডাউনি মিলডিউ উল্লেখযোগ্য। পোকামাকড় ও রোগ দমনের জন্য নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী কীটনাশক প্রয়োগ করা জরুরি।নিয়মিত কীটনাশক প্রয়োগ করলে ভুট্টার ফলন অনেক অংশে বেড়ে যায়। মনে রাখবেন গাছ ঠিক থাকলে ফলন বৃদ্ধি পাবেই।
ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
ভুট্টার গাছ যখন পুরোপুরি পরিপক্ক হয় এবং শস্যের রঙ সোনালী হয়ে যায়, তখন ফসল কাটা যায়। শস্য কাটার পর শুকানোর জন্য রোদে রাখা উচিত। ভুট্টার শস্য ভালোভাবে শুকিয়ে সংরক্ষণ করলে দীর্ঘ সময় ভালো থাকে।
হাইব্রিড ভুট্টা চাষ বাংলাদেশে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, কারণ এটি স্থানীয় জাতের তুলনায় উচ্চ ফলনশীল এবং অধিক লাভজনক। সঠিক চাষ পদ্ধতি এবং পরিচর্যার মাধ্যমে, কৃষকরা ভালো ফলন পেতে পারেন। সঠিক জাত নির্বাচন এবং আধুনিক চাষ পদ্ধতি ব্যবহার করলে ভুট্টা চাষে সাফল্য নিশ্চিত করা সম্ভব।